Sunday, May 17, 2015

প্রসঙ্গ অবৈধভাবে সমুদ্রপথে মানবপাচার !!!

বাংলাদেশ থেকে সমুদ্রপথে মানবপাচার সমস্যা নিয়ে আলোচনার জন্য বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ.এইচ. মাহমুদ আলী আগামীকাল মালয়েশিয়া যাচ্ছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, তার এই সফরে সমুদ্রপথে অবৈধভাবে মানবপাচার বন্ধের জন্য যৌথ উদ্যোগ আলোচনায় অগ্রাধিকার পাবে। এছাড়া মানবপাচার বন্ধে বৃহত্তর পরিসরে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মধ্যে আলোচনার জন্য মালয়েশিয়া এবং থাইল্যান্ডকে আগেই চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ।


অবৈধভাবে মালয়েশিয়া বা থাইল্যান্ড গিয়ে বাংলাদেশী যারা আটকা পড়েছে, তাদের ফেরত আনার ব্যাপারেও বাংলাদেশ সহযোগিতা চাইছে। কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশ হাইকমিশনের শ্রম বিষয়ক কর্মকর্তা সাইদুল ইসলাম জানান, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সফরের সময় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাবে মানুষ পাচার বন্ধের বিষয়টি। যারা ইতোমধ্যে পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে মালয়েশিয়া বা থাইল্যান্ডে গিয়ে আটকে পড়েছে, তাদের কিভাবে ফেরত আনা যায়, সেটা নিয়েও এই বৈঠকে কথা হবে বলে জানা গেছে।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বিবিসিকে জানান, বাংলাদেশ এই মানুষ পাচার বন্ধে আঞ্চলিক সহযোগিতা চায়। তিনি বলেন, বাংলাদেশের একার পক্ষে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। তাছাড়া নৌকায় যারা এভাবে সাগর পাড়ি দিয়ে সেখানে যেতে চাচ্ছে, তাদের মধ্যে বাংলাদেশের তুলনায় অন্য দেশের নাগরিকরাই সংখ্যায় বেশি। তাই এক্ষেত্রে আঞ্চলিক সহযোগিতা জরুরী।

বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম বলছে, থাইল্যান্ডের দক্ষিণ উপকূলের আন্দামান সাগরে এখনো অনেক মানুষ মাবপাচারকারীদের খপ্পরে পরে নৌকায় ভাসছে। আন্দামান সাগরে নৌকায় ভাসতে থাকা অভিবাসীরা খাদ্য ও পানির তীব্র সংকটে রয়েছে। তাদের দুর্দশা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, অনেককে বেঁচে থাকার জন্য মূত্র পান করতে হচ্ছে। সংবাদ সংস্থা এএফপি এই ছবিটি আজ থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলীয় দ্বীপ কোহ লিপে থেকে তুলেছে। থাইল্যান্ডের দক্ষিণ উপকূলে সরেজমিনে দেখে বিবিসির সংবাদদাতা জনাথান হেড এমনটাই দাবি করেছেন। বিবিসি বাংলার খবরে এ কথা বলা হয়েছে, এসব মানুষকে অবৈধভাবে সমুদ্রপথে থাইল্যান্ড হয়ে মালয়েশিয়ায় পাচার করা হচ্ছিল। থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ এই অবৈধ অভিবাসীদের ঠেকাতে যে কঠোর অবস্থান নিয়েছে, তার ফলে তারা এখন মারাত্মক দুর্দশায় পড়েছে।

বিবিসির সংবাদদাতা জনাথান হেড সাগরে ভাসতে থাকা এমন একটি ট্রলার সরেজমিনে দেখতে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে তিনি তাঁর অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেন। তিনি জানান, থাইল্যান্ড উপকূলের অদূরে আন্দামান সাগরে মাছ ধরার একটি ট্রলারে তিনি প্রায় ৩৫০ জনকে দেখেছেন। তাদের অনেকে এক সপ্তাহ ধরে খাদ্য ও পানীয়ের অভাবে নিজেদের মূত্র পান করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে।

বিবিসির এই সংবাদদাতা যখন একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে ট্রলারটির কাছাকাছি যান, তখন তিনি দেখতে পান সেটি খুবই পুরোনো একটি মাছ ধরার নৌকা। সেখানে গাদাগাদি করে ৩৫০ জনের মতো নারী, পুরুষ ও শিশু রয়েছে। তাদের অধিকাংশই রোহিঙ্গা। তারা জানিয়েছে, দুই মাস ধরে তারা এই ট্রলারে রয়েছে। কিন্তু ছয় দিন আগে নৌকার চালক ও কর্মচারীরা ইঞ্জিন অকেজো করে পালিয়ে গেলে এই করুণ অবস্থার মধ্যে পড়ে তারা। ইতোমধ্যে খাদ্য ও পানির অভাবে ওই নৌকার ১০ জন মানুষ মারা গেছে।

জনাথন যখন ট্রলারটির কাছে পৌঁছান, তখন ট্রলারটি থেকে খাবার ও পানি চেয়ে লোকজন আকুতি জানাচ্ছিল। তিনি দাবি করেন, তিনি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলেন লোকজন বোতলে ভরা নিজেদের মূত্র পান করছিল। থাই নৌবাহিনীর একজন কর্নেল জনাথনকে জানিয়েছেন, এই অভিবাসীরা মালয়েশিয়া যেতে চেয়েছিল। যদি তারা ফিরে যেতে রাজি হয়, তাহলে থাইল্যান্ড তাঁদের খাবার, পানি ও চিকিৎসা সহায়তা দেবে।

ওদিকে ইন্দোনেশিয়ার জলসীমা থেকে অভিবাসী বোঝাই একটি নৌকা সমুদ্রে ফেরত পাঠিয়েছে দেশটির নৌবাহিনী। নৌকাটিতে কয়েকশ’ বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনীর ‍মুখপাত্র মনহন সিমরাংকির বলেছেন, 'নৌকাটিকে সমুদ্রে ফেরত পাঠানোর আগে সোমবার আমরা অভিবাসীদের খাবার ও পানি সরবরাহ করেছি। অভিবাসীরা মালয়েশিয়ায় যেতে চেয়েছে বলেই নৌ-যানটিকে আমরা সমুদ্রে ফেরত পাঠিয়েছি। নৌকার যাত্রীরা বেঁচে আছে এবং বেশ সুস্থ আছে। তারা কেবল সাহায্য চেয়েছিল। তারা ইন্দোনেশিয়ায় যেতে রাজি ছিল না। তারা মালয়েশিয়া যেতে চেয়েছিল। তাই আমরা খাবার, পানি ও ওষুধ সরবরাহ করে তাদের গন্তব্যের পথে পাঠিয়ে দিয়েছি।'

অভিবাসী বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা (আইওএম) এ ঘটনাকে দুঃখজনক আখ্যা দিয়েছে। আইওএম’র মুখপাত্র জো লোরি বিবিসি’কে বলেন, 'ঘটনা সত্য হলে তা হবে খুবই দুঃখজনক। ওই মানুষগুলোর স্থলে আশ্রয়ের প্রয়োজন ছিল। চলতি বছরের মার্চ মাস থেকে ছোট ছোট জাহাজে করে এসব অসহায় মানুষ সমুদ্রে ভাসছে। খুব কম খাবার ও পানি খেয়ে তারা জীবন ধারণ করছে। এরই মধ্যে অনেকে বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হয়েছে। তাদের জরুরি সাহায্য প্রয়োজন। বেরিবেরি রোগ মানুষকে জীবন্ত কঙ্কালে পরিণত করে। তাদের জরুরি ভিত্তিতে মানবিক সাহায্যের প্রয়োজন।

জাতিসংঘের পক্ষ থেকেও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সরকারের কাছে এসব শরণার্থী বোঝাই নৌকা সমুদ্রে ফেরত না পাঠানোর অনুরোধ জানানো হয়েছে। থাইল্যান্ডের জলসীমায় এখনো আরো ৮ হাজার বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা শরণার্থী অবস্থান করছে বলে সোমবার বিবিসি’কে জানিয়েছিল আইওএম। জাতিসংঘের বলছে, ওই সব নৌযান ক্ষুধার্ত ও রুগ্ন শরণার্থী দিয়ে বোঝাই। থাইল্যান্ডে ধরপাকড় শুরু হওয়ার পর মানবপাচারকারীরা অসহায় ওইসব মানুষকে ফেলে চলে গেছে।

এদিকে রোববার রাত ও সোমবার থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় উদ্ধার হওয়া দুই হাজারের বেশি অবৈধ অভিবাসীকে নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে আলোচনার জন্য দুই দেশের পুলিশ প্রধানদের বৈঠকে বসার কথা রয়েছে।

গত কয়েক মাস ধরে অবৈধ অভিবাসী সমস্যা নিয়ে অস্থিরতা বিরাজ করছে পুরো দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সমুদ্র অঞ্চলে। একের পর এক পাওয়া যাচ্ছে অবৈধ আভিবাসীবোঝাই নৌকা। যাদের বেশিরভাগই মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি। জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা ইউএনএইচসিআরের তথ্য মতে, চলতি বছরের প্রথমভাগে অন্তত ২৫ হাজার রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি পাচারের শিকার হয়েছেন। যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী, ছয় হাজারেরও বেশি অসুস্থ ও ক্ষুধার্ত অভিবাসী সমুদ্রে ভাসমান অবস্থায় উদ্ধারের অপেক্ষায় আছেন। উদ্ধার হওয়া অনেকে বলছেন, সারেংরা তাদের ফেলে নৌকা ছেড়ে চলে যাচ্ছে। অসহায় এই ব্যক্তিরা জানে না, এরপর তাদের কী হবে।

এসব অসহায় ব্যক্তিদের উদ্ধারের জন্য থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া সরকারকে আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ। কিন্তু দেশগুলোর সরকারের কাছ থেকে এখনো কোনো সাড়া পাওয়া য়ায়নি। থাইল্যান্ডের ক্ষমতাশীন জান্তা সরকারের মুখপাত্র মেজর জেনারেল ওরেনচং সুখনধাপাতিপাক রয়টার্সকে বলেন, “আমি যতদূর জানি, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নৌকায় করে আসা আর কোনো অবৈধ অভিবাসীদের ঢুকতে দেওয়া হবে না।”

তবে জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থা ইউএনএইচসিআরের উদ্ধার অভিযানের আবেদন বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে তিনি রাজি হননি। মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও এই আবেদন বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে থাইল্যান্ড নেভি বুধবার জানিয়েছে, 'পুশ ব্যাকের' মতো কোনো নীতিগত সিদ্ধান্ত তাদের নেই। রিয়ার অ্যাডমিরাল কান ডিউবল রয়টার্সকে বলেন, “তারা যদি থাই সমুদ্রসীমায় চলে আসে, তবে আমরা অবশ্যই তাদের খাদ্য ও পানি দিয়ে সাহায্য করব। মানবিক কারণেই আমারা তাদের অকূল সমুদ্রে ফিরিয়ে দেব না।”

মূলত অবৈধ মানবপাচার বিষয়ে এই তিন দেশের পুলিশের শক্ত অবস্থানের কারণেও অভিবাসীদের সমুদ্রে ফেলে পালাচ্ছে পাচারকারীরা। গত সপ্তাহে থাইল্যান্ডে গণকর থেকে ৩৩ অবৈধ অভিবাসীর মৃতদেহ পাওয়ার পর বেরিয়ে আসতে থাকে একের পর এক কবর, যা রাষ্ট্রীয় ভাবমূর্তি নষ্ট করায় পুলিশ কঠোর হতে বাধ্য হয়।

গত সপ্তাহে এক হাজার অবৈধ অভিবাসী মালয়েশিয়ার ল্যাকাউই দ্বীপে এসে ভেড়ে। তাদের সেখানকার একটি সরকারি ক্যাম্পে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। তবে এরপর আর কোনো নৌকা ভেড়াতে বাধা দেয়া হচ্ছে বলে রয়টার্সকে জানান মালয়েশিয়া সরকারের এক সমুদ্র কর্মকর্তা। মালয়েশিয়ান মেরিটাইম এনফোর্সমেন্ট এজেন্সির উত্তরাঞ্চলীয় প্রধান অ্যাডমিরাল তান কো কো কিউ রয়টার্সকে বলেন, “আমরা আর তাদের সুযোগ দিচ্ছি না। এটি রাষ্ট্রীয় নীতিগত সিদ্ধান্ত।”

সোমবারও ইন্দোনেশিয়া কর্তৃপক্ষ আচেহ প্রদেশের উত্তর উপকূল থেকে খাদ্য, পানি ও ওষুধ দিয়ে ৫০০ জনকে মালয়েশিয়ার দিকে ফেরত পাঠিয়েছে। যদিও এটিকে ‘প্যুশব্যাক’ বলতে নারাজ তারা। ইন্দোনেশিয়ার নেভি বলছে, নৌকাটির যাত্রীরা মালয়েশিয়ায় যেতে চেয়েছিল, ইন্দোনেশিয়ায় নয়।

রোববারও প্রায় ৬০০ অভিবাসীকে আচেহ উপকূল থেকে উদ্ধার করা হয়। ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বুধবার এ তথ্য দিয়ে সাংবাদিকদের জানান, ইন্দোনেশিয়া পুলিশ তাদের খাদ্য দিয়ে সাহায্য করেছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন শরণার্থী ও আভিবাসী সংস্থার সঙ্গেও যোগাযোগ রাখছে তারা।

এদিকে সোমবার আশিয়ান পার্লামেন্টারিয়ানস ফর হিউম্যান রাইটস ইন্দোনেশিয়া সরকারের পুশব্যাক নীতির সমালোচনা করেছে। আন্তর্জাতিক আইনি সাহায্য সংস্থা এবিএইচআরের প্রধান ও মালয়েশিয়ার সংসদ সদস্য চার্লস সান্তিয়াগো রয়টার্সকে বলেন, “অভিবাসীদের উন্মুক্ত সমুদ্রের দিকে ঠেলে দিয়ে এটা আমার সমস্যা নয় বলে চোখ বন্ধ করা, এতবড় আঞ্চলিক সমস্যার সমাধান হতে পারে না। তিন দেশের অবস্থান এ সমস্যাকে আরও ঘনীভূত করছে।”

মালয়েশিয়ান হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সুনাই পাহসুক রয়টার্সকে বলেন, “যখন দেশগুলো যেমন থাইল্যান্ড 'পুশব্যাক' নীতি অবলম্বন করছে, তখন উপকূলে আমরা রোহিঙ্গাদের মৃতদেহ পাচ্ছি। এই তিন দেশ যদি পুশব্যাক নীতি নিয়ে এগোতে থাকে, তবে তাদের হাতে সাধারণ মানুষের রক্তের গন্ধ লেগে থাকবে।”

এদিকে মালযেশিয়ার পুলিশ থাই পুলিশের সঙ্গে যৌথ অভিযানের সফলতা দাবি করেছে। তারা থাইল্যান্ডের পশ্চিমের ও মালয়েশিয়ার উত্তরের মানবপাচারের সাতটি চক্রকে ধসিয়ে দেওয়ার দাবি করেছে। পুলিশের দাবি, পাচারকারীরা ইউএনএইচসিআরের কাগজও জাল করে। মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্র উপমন্ত্রী ওয়ান জুনাইদি দক্ষিণ এশিয়ার সারকারদের প্রতি মিয়ানমারের উপর চাপ প্রয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন বলে সংবাদ প্রকাশ করেছে ব্যাংকক পোস্ট।

“আপনারা গণতন্ত্র নিয়ে কথা বলেন, তাহলে নাগরিকদের উচ্ছিষ্ট বা অপরাধীদের মতো দেখবেন না, যাতে তাদের দেশ ছেড়ে পালাতে হয়।” ওয়ান জুনায়েদি জানান, শিগগিরই বাংলাদেশ, মিয়ানমারসহ উন্নয়নশীল দেশগুলো এবং আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন তারা। অন্যান্য দেশগুলোকে আমি অনুরোধ করব, গ্যালারিতে বসে কথা না বলে, নিজেদের দরজা অসহায় আভিবাসীদের জন্য খুলে দিতে।”

জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, মালয়েশিয়ায় বর্তমানে প্রায় দেড় লাখ অবৈধ অভিবাসি অবস্থান করছেন। এর মধ্যে ৪৫ হাজারেরও বেশি মিয়ানমারের রোহিঙ্গা। বাকিদের বেশিরভাগ বাংলাদেশি। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের উপ-প্রধান ফিল রবার্টসন বলেন, মালযেশিয়া, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ার শক্ত অবস্থান রোহিঙ্গা সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলেছে। আর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, উদ্ধার হওয় বাংলাদেশি আভিবাসীদের দেশে ফেরত আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, এভাবে দীর্ঘদিন ধরে মানবপাচারকারীরা মায়ানমারের রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি অবৈধ অভিবাসিদের সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডে পাচার করে আসছিল। গত কয়েক মাসে এর তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার পুলিশ কঠোর অবস্থান নেওয়ার ফলে দুর্দশা আরো ঘনিভূত হয়েছে। কারণ, মানবপাচারকারীরা ইঞ্জিন বন্ধ করে নৌকা থেকে পালিয়ে যাচ্ছে। এসব নৌকাগুলোতে তীব্র খাদ্য ও পানির সংকটের কারণে অনেকে মারা যাচ্ছে।

এখন কেবল বাংলাদেশ থেকে উদ্যোগ নিলে সমুদ্রপথে এই মানবপাচার বন্ধ হবে না। বাংলাদেশের পাশাপাশি মায়ানমারকেও এই উদ্যোগে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ পাচার হওয়া অধিকাংশরাই এই দুটি দেশের নাগরিক। তাই মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডের সরকারের কাছে দুটি দেশের পক্ষ থেকেই যৌথ উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ মায়ানমার বাংলাদেশের এই উদ্যোগে সাড়া না দিলে আঞ্চলিক এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডের পুশব্যাক নীতির ফলে পরিস্থিতি আরো ভয়ংকর মানবিক বিপর্যয় সৃষ্ট করবে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ধারণা।

১৯৭৮ সালে বাংলাদেশের কক্সবাজারে মায়ানমার থেকে মুসলিম রোহিঙ্গাদের অবৈধভাবে শরনার্থী হিসেবে আশ্রয় নেবার পর থেকেই এই সমস্যার শুরু। এসব রোহিঙ্গাদের থেকেই স্থানীয় বাংলাদেশি ও থাইল্যান্ডের দালালদের মাধ্যমে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া যাবার একটি মানবপাচার রুট এরা আবিস্কার করতে সক্ষম হয়। তখন থেকেই অবৈধভাবে সমুদ্রপথে এসব মানবপাচারকারীরা রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশিদের পাচার করে আসছে। সাম্প্রতিক সময়ে এই মানবপাচারের সংখ্যা কয়েকগুন বেড়ে গেছে।

মায়ানমারের সামরিক সরকারের সঙ্গে অন্যদেশগুলোর তেমন ভালো সম্পর্ক না থাকায় আঞ্চলিক এই সমস্যা দীর্ঘদিন ধরেই জিয়িয়ে রয়েছে। বাংলাদেশে এখনো প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা শরনার্থী কক্সবাজারের উখিয়ায় বসবাস করছে। জাতিসংঘ উদ্বাস্তুবিষয়ক হাইকমিশন ইউএনএইচসিআর এই রোহিঙ্গাদের দায়িত্বে রয়েছে। কিন্তু এই অবৈধ ভাবে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের কারণে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল সীমান্তে মায়ানমার ও সমুদ্রপথে রোহিঙ্গাদের এই অপতৎপরতা কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না। টাকার বিনিময়ে মানবপাচারকারী এসব দালালরা একদিকে সমুদ্রপথে মানবপাচার করছে। অন্যদিকে মায়ানমার থেকে প্রচুর নেশাজাতীয় দ্রব্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। এসব রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে নানানভাবে অসত কর্মকর্তা কর্মচারীদের মাধ্যমে মানবপাচারের এই রুট চালু রাখতে সক্ষম হচ্ছে। এমন কি বাংলাদেশি জাল পাসপোর্ট এবং জাতিসংঘের ভুয়া কাগজপত্রও এরা ম্যানেজ করতে সক্ষম হচ্ছে।

আঞ্চলিক এই সমস্যা সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট সবগুলো দেশকেই আন্তরিকভাবে যৌথ উদ্যোগে এই সমস্যা মোকাবেলা করতে হবে। মায়ানমারকে প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগ করে হলেও এই যৌথ উদ্যোগে অংশিদার হতে বাধ্য করতে হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা শরনার্থীদের যতশীঘ্র সম্ভব মায়ানমারে ফেরত নেবার উদ্যোগ নিতে হবে। যতদিন রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ ভূখণ্ডে অবৈধভাবে থাকার সুযোগ পাবে, ততদিন এই সমস্যার সমাধান হবে না। বরং নেশাজাতীয় দ্রব্য পাচার, মানবপাচারের মত আরো বড় বড় অপরাধের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাবে। সীমান্তে উক্তেজনা, পুশব্যাক ও পুশইন, অবৈধ অভিবাসি এগুলো আরো বেড়ে যাবে।

আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভূ-রাজনৈতিক কারণে বর্তমানে বঙ্গোপসাগর, আন্দামান সাগর, চীন সাগর ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সমুদ্রাঞ্চল গুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার কারণে, এ ধরনের মানবিক আঞ্চলিক সমস্যা তৈরি করার পেছনে বড় বড় রাষ্ট্রগুলোর গোপন কোনো মিশন রয়েছে। সবাই নিজ এই অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারের যে কৌশল নিয়েছে, তারই অংশ হিসেবে এসব অবৈধ কর্মকাণ্ডে তাদের ইন্ধন থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাছাড়া এই অঞ্চলে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন গ্যাস ও সামুদ্রিক প্রাণীসম্পদ রয়েছে। তাই এই আঞ্চলিক সমস্যা সমাধানে কেবল বাংলাদেশ, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া আন্তরিক হলেও এটাকে কার্যকর করার জন্য বৃহৎ শক্তিধর চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় দেশগুলোকে জড়াতে না পারলে, তা আলোর মুখ দেখবে না। অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, এটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক সমস্যা হলেও এখানে আন্তর্জাতিক মহলের সাম্রাজ্যবাদী অংশিদারিত্ব রয়েছে। যা সমস্যাকে সমাধানের দিকে না নিয়ে দিন দিন আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।
........................................
১৫ মে ২০১৫
ঢাকা

তথ্যসূত্র: বিবিসি, রয়টার্স, বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক, ব্লগ, ও টেলিভশন

No comments:

Post a Comment